বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫, ০২:৫১ পূর্বাহ্ন

বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ সম্ভব নয় : সাক্ষাৎকারে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ঢাকা |

বিশ্বজুড়ে যখন মৃত্যুদণ্ড বিলোপের দাবি জোরালো হচ্ছে, বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার ও তার ন্যায্যতা নিয়ে বিতর্ক কিছুটা হলেও সামনে আসছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আহ্বান, বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের সিদ্ধান্ত এবং বাংলাদেশে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অবস্থানের পটভূমিতে সম্প্রতি আলোচনায় উঠে এসেছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের সাম্প্রতিক সফরের প্রেক্ষিতে সচিবালয়ে এক বৈঠক শেষে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সেই আলোচনার ধারাবাহিকতায় আমাদের একান্ত সাক্ষাৎকারে আসিফ নজরুল বলেন, “বাংলাদেশে বাস্তবতার নিরিখে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করা সম্ভব নয়।”

এসময় তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মৃত্যুদণ্ড বিলাপ বিষয়ক মানবাধিকার কর্মী ও লেখক হোসাইন মোহাম্মদ সাগর। সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জ্য তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন: বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের যে জোরালো ধারা, সেখানে বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে?

আসিফ নজরুল: মৃত্যুদণ্ড বিলোপ একটি আন্তর্জাতিক প্রবণতা ঠিকই। জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা বারবার বলছে, এই শাস্তি অমানবিক এবং ভুল বিচারের ঝুঁকি বহন করে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনে শতবর্ষ ধরে যে কাঠামো আছে, সেখানে মৃত্যুদণ্ড একটি বৈধ ও কার্যকর ব্যবস্থা। হুট করে এটাকে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়।

প্রশ্ন: অর্থাৎ আপনি বলছেন, মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিলোপের সম্ভাবনা নেই?

আসিফ নজরুল: অন্তত এখনই না। দেশের আইনগত কাঠামো, বিচার ব্যবস্থার বাস্তবতা এবং জনগণের ন্যায়বিচার প্রত্যাশার সঙ্গে এটি জড়িত। যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, ধর্ষণ বা নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে সমাজ এখনো সর্বোচ্চ শাস্তির পক্ষে।

প্রশ্ন: কিন্তু আন্তর্জাতিক অনেক সংগঠন বলছে, এই আইন মানবাধিকারের পরিপন্থী।

আসিফ নজরুল: তাদের বক্তব্য তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঠিক আছে। তারা আন্তর্জাতিক মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে বিচার করছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বাস্তবতা বড় বিষয়। ২০১৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যে ৩০টির বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই ছিল চাঞ্চল্যকর হত্যা বা যুদ্ধাপরাধের মামলা।

প্রশ্ন: জাতিসংঘ কি বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এই বিষয়ে?

আসিফ নজরুল: জাতিসংঘ চাপে না, তারা সুপারিশ করে। হাই কমিশনার ফলকার টুর্কও আমাদের বলেছিলেন, “আপনারা কি মৃত্যুদণ্ড রদ করতে পারবেন?” আমি স্পষ্ট করে বলেছি—এটা এই মুহূর্তে বাস্তবসম্মত নয়। তবে আমরা সুবিচার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

প্রশ্ন: তাহলে কি মৃত্যুদণ্ডের জায়গায় বিকল্প সাজা নিয়ে ভাবা যেতে পারে?

আসিফ নজরুল: অবশ্যই, আলোচনা হতে পারে। তবে সেটা একাডেমিক ও সামাজিক স্তর থেকে শুরু হওয়া দরকার। সরকার আইন সংস্কারের জন্য জাতিসংঘের ফরেনসিক বা কারিগরি সহায়তা নিতে প্রস্তুত। কিন্তু পরিবর্তনটা ধাপে ধাপে হতে হবে, চাপ দিয়ে নয়।

প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন—আপনি কি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে নাকি বিপক্ষে?

আসিফ নজরুল: আমি ব্যক্তি হিসেবে সবসময় সুবিচার, নিরপেক্ষতা এবং মানবিকতার পক্ষে। তবে রাষ্ট্রের উপদেষ্টা হিসেবে আমাকে দেখতে হয়, মানুষের নিরাপত্তা, বিচারপ্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আইনি কাঠামোর বাস্তবতা। ব্যক্তিগত মতামত এবং রাষ্ট্রীয় নীতি সবসময় এক নাও হতে পারে।

বিশ্ব যখন মৃত্যুদণ্ড বিলোপের দাবি তোলে, তখন সেটিকে এক মানবিক আহ্বান হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের মতো দায়িত্বশীল অবস্থানে থাকা ব্যক্তির কণ্ঠে বাস্তবতার কড়াকথা উঠে আসে। একদিকে মানবাধিকার, অন্যদিকে ন্যায়বিচারের কঠোরতা—এই দুইয়ের মধ্যবর্তী জায়গা নিয়েই বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে ভবিষ্যতের আলোচনা গড়ে উঠবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

 

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর

মৃত্যুদণ্ড বিলোপ বিষয়ক মানবাধিকার কর্মী ও লেখক

✉️ sendhusagar@gmail.com

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com